মেসির জয়ধ্বনি, ডি মারিয়ার শেষ সুরে: কোপা আমেরিকা ২০২৪
আর্জেন্টিনার কোপা আমেরিকা জয় বারবার ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ২০১৪ সালের ১৩ই জুলাই এর সেই বিভীষিকাময় রাতে, ফিফা প্রেসিডেন্ট শেপ ব্লাটারের হাত থেকে গোল্ডেন বল নিয়ে মাথা নিচু করে বেরিয়ে যাচ্ছেন লিও মেসি পায়ে যেন তার কত বছরের ক্লান্তি আর বুকে মস্ত পাথরের ভার। তার বছর দুই পর আবার কোপা ফাইনালের ঝলমলে সেই মুহূর্ত কোলাহলময় স্টেডিয়াম কিন্তু আবার সেই হতাশা পেনাল্টি মিস করে খলনায়ক হয়ে যাওয়া, তারপর বিদায় ঘোষণা ফুটবলকে। এই হতাশার মেঘ যেন ঘিরে ধরেছিল শুধু মেসিকে নয়, আর্জেন্টিনা সহ গোটা বিশ্বের অগণিত সমর্থককে, এবং সেই মেঘ কাটতে সময় লেগেছিল আরো বেশ কিছু বছর। বারবার এটাই মনে হতো যে আমাদের আগের প্রজন্মের কাছে ফুটবলের ঈশ্বর ছিলেন মারাদোনা, কিন্তু আমাদের প্রজন্মের ঈশ্বর মেসিকে কি শূন্য ঝুলি নিয়েই তার ফুটবল ক্যারিয়ার শেষ করতে হবে?
মেসির জয়ধ্বনি :
পথ ছিল কঠিন আর অপেক্ষা ছিল দীর্ঘ কিন্তু নিয়তি যে উপহারের ডালি সাজিয়ে বসেছিল তা ছিল অবিস্মরণীয়। ২০২১ সালে কোপা আমেরিকা জয় আর তা থেকেই আর্জেন্টিনার ট্রফির করা কাটতে থাকে আর 2022 সালের 19 শে ডিসেম্বরের সেই সেই অবিস্মরণীয় রাত, প্রথম ছুঁয়ে দেখা স্বপ্নকে। তিন নম্বর তারাটি আকাশ থেকে খসে পড়ল আর্জেন্টিনার জার্সিতে।এরপর ২০২৪ এর ১৫ই জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামির হার্ড রক্ স্টেডিয়াম।
সহজ ছিল না এই পথ সেখানেও খেলার মাঝে নেমে এলো বিপর্যয়, দ্বিতীয়ার্ধে ৬৫ মিনিটে চোট পেয়ে মাঠ ছাড়তে হল মেসিকে, রিজার্ভ বেঞ্চে বসে তখন হাপুস নয়নে তিনি কাঁদছেন, সেই নয়নে চোটের যন্ত্রণার থেকেও পূর্বস্মৃতির ভয়ই বেশি তারা করছিল। কিন্তু সতীর্থরা তাকে ব্যর্থ হতে দেয়নি দিনের শেষে হাসি ফুটিয়েছে মেসি সহ বিশ্বের সকল সমর্থকের মুখে। পরপর জোড়া কোপা আমেরিকা জয় আর্জেন্টিনার। যদিও এবারের কোপা আমেরিকায় মেসি নিজেকে সেভাবে মেলে ধরতে পারেনি, আসলে বয়স তো বাড়ছে কিন্তু তার প্রতি এক্সপেক্টেশন কমছে কি? না! দিনশেষে তিনিই আর্জেন্টিনার অধিনায়ক। তার হাতে কাপ তুলে দেয়ার জন্যই সতীর্থরা প্রাণপণ চেষ্টা করে গেছে। জীবনের সায়াহ্নে এসে এর থেকে বেশি প্রাপ্তি আর কি হতে পারে।
মেসি বারবার তাদের কথা বলে যারা অতলে তলিয়ে গিয়েও আবার ফিরে এসে রূপকথা লেখে। জীবনযুদ্ধে লড়াই করতে থাকা মানুষের কানে কানে এসে সে বলে যায়, একদিন! একদিন সুবিচার পাবেই একদিন জয় হবেই।
গত চার বছরে মেসি আর্জেন্টিনার জার্সিতে চারটি খেতাব জিতেছেন দুটি কোপা আমেরিকা একটি বহুকাঙ্খিত বিশ্বকাপ আরেকটি ফিনালিসিমা। আর এরই সঙ্গে হয়তো শেষবারের মতো খেলে ফেললেন কোপা আমেরিকা। তবে সেই তারকা খচিত আর্জেন্টিনায় কোপা আমেরিকা জিতিয়ে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারকে বিদায় জানালেন ডি মারিয়া।
ডি মারিয়ার বিদায়ের সুর:
বিশ্বের সেরা টুর্নামেন্ট গুলোর ফাইনালে গোল আছে ডি মারিয়ার। আজ মনে পড়ে ২০১৪ সালের ১৩ই জুলাইয়ের ফাইনালের কথা তারা কখনোই ডি মারিয়াকে ভুলতে পারবে না যারা ১১৩ মিনিট পর্যন্ত রিজার্ভ বেঞ্চের দিকে একটু আশা নিয়ে তাকিয়ে বসেছিল। সেখান থেকে আমরা অনেকটা পেরিয়ে এসেছি। ২০২২ এর বিশ্বকাপের ফাইনালে গোলের পর হৃদয় চিহ্ন এঁকে ভক্তদের প্রতি ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছেন তিনি। তবে জীবনটা খুব সহজ ছিল না ডি মারিয়ার আর যে নীল সাদা জার্সিতে আমরা তাকে দেখি, ছোটবেলায় সেই সাদা রংয়ের ছিটেফোঁটাও তার জীবনে ছিল না, বাবা কাজ করতেন কয়লা খনিতে তাকেও সাহায্য করতে হতো সেই কাজে।
ছোটবেলা থেকেই খুবই ছটফটে, দুরন্ত ছিলেন তিনি, একদিন এক ডাক্তারের পরামর্শে তার মা তাকে ফুটবলের সাথে পরিচয় করান। তখন কে জানত সেই কয়লা মাখা ছেলেটাই সমস্ত কালো রং সরিয়ে জীবনটা রঙিন করে তুলবে।, বিপক্ষের ডিফেন্ডারকে ঘোল খাইয়ে জিতিয়ে আনবে দলকে। আর্জেন্টিনার জার্সিতে ১৪৪ ম্যাচে ৩১ টি গোল তার। রোলান্ডো,মেসি দুজনের সাথেই তিনি খেলেছেন। মেসির সাথে তার বন্ধুত্ব বোঝাপড়া ফুটবল মাঠে সমস্ত দর্শককে মাতিয়ে রাখত। একে অপরের দিকে পাশ বাড়ানো গোল করে জয় ছিনিয়ে আনা সবই শেষ বেলায় বারবার মনে পড়ছে। আজ যখন দ্বিতীয়ার্ধে মেসি চোট পেয়ে উঠে গেলেন, তখন ডি মারিয়ার হাতেই ক্যাপ্টেনের আর্মব্যান্ড। আবারো নেতৃত্ব দিলেন দলকে ছিনিয়ে আনলেন জয়। আর তারপর সেই ১০ নম্বর জার্সি গায়ে “লিটিল বয় ফ্রম রোজারিও” হাতে কাপটাকে শিশুর মতো নিয়ে এগিয়ে গেলেন সতীর্থদের সামনে, তৈরি হলো এক স্বর্গীয় মুহূর্ত। সেই স্বর্গ যেখানে মারাদোনা থাকেন, মেসি থাকেন আর থাকেন এক জন “এঞ্জেল” ডি মারিয়া।