রাখি বন্ধন: স্নেহ, সুরক্ষা ও সম্পর্কের এক গভীর মেলবন্ধন
রাখি বন্ধন, যা রাখী উৎসব নামেও পরিচিত, ভারতের অন্যতম প্রধান ও প্রাচীন উৎসব। প্রতি বছর শ্রাবণ মাসে পূর্ণিমার দিনে এই উৎসব পালিত হয়। এই উৎসবে মূলত ভাই-বোনের সম্পর্কের এক উদযাপন ঘটে, এবং উৎসবটিকে স্নেহ ও সুরক্ষার প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। যদিও এর মূল উৎপত্তিস্থল ভারতীয় উপমহাদেশে, তবে আজকের দিনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী ভারতীয়রা এই উৎসব পালন করে থাকেন।
রাখি বন্ধনের ইতিহাস ও গুরুত্ব :
রাখি বন্ধনের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন এবং এটি বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি ও কিংবদন্তির সঙ্গে যুক্ত।
এই পৌরাণিক কাহিনির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন কৃষ্ণ ও দ্রৌপদীর একটি কাহিনী। দ্রৌপদী যিনি কৃষ্ণের হাত থেকে রক্তপাত রোধ করতে তার দেহের কাপড় থেকে এক টুকরো ছিঁড়ে কৃষ্ণের হাতে বেঁধে দিয়েছিলেন। পরে দ্রৌপদীর দুঃসময়ে কৃষ্ণ সেই কাপড়ের টুকরো দিয়ে অলৌকিক ভাবে দ্রৌপদীর লজ্জা নিবারণ করেছিলেন। তাই এই রাখী, সম্পর্কের বন্ধনকে শক্তিশালী করে এবং রক্ষার প্রতিশ্রুতি হিসেবে বিবেচিত হয়।
অন্য আর একটি গল্পে রয়েছে, দৈত্যরাজা বলি ছিলেন বিষ্ণুর ভক্ত। বলির রাজ্য রক্ষা করার জন্য বিষ্ণু বৈকুণ্ঠ ছেড়ে চলে এসেছিলেন তার রাজ্যে। বিষ্ণুর স্ত্রী লক্ষ্মী তার স্বামী বিষ্ণুকে ফিরে পাওয়ার জন্য এক সাধারণ মেয়ের ছদ্মবেশে বলিরাজের কাছে আসেন এবং তাঁকে বলেন যে, তাঁর স্বামী নিরুদ্দেশ। তখন বলি তার রাজ্যে ছদ্মবেশী লক্ষ্মীকে তাঁর স্বামী ফিরে না আসা পর্যন্ত আশ্রয় দেন। সেই সময় শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা উৎসবে লক্ষ্মী বলিরাজার হাতে একটি রাখী বেঁধে দেন। বলিরাজ এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে লক্ষ্মী আত্মপরিচয় দিয়ে সব কথা খুলে বলেন। এতে বলিরাজ মুগ্ধ হয়ে বিষ্ণুকে বৈকুণ্ঠে ফিরে যেতে অনুরোধ করেন। বলিরাজা বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেন। সেই থেকে শ্রাবণ পূর্ণিমা তিথিটি বোনেরা রাখীবন্ধন হিসেবে পালন করে।
আলেকজান্ডার ও পুরু রাজার গল্প
একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী, ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করলে আলেকজান্ডারের স্ত্রী রোজানা তার স্বামীকে বাঁচানোর জন্য রাজা পুরুকে একটি পবিত্র সুতো পাঠিয়ে তাঁর কাছে অনুরোধ করেন, যেন তিনি আলেকজান্ডারের কোনও ক্ষতি না করেন। পুরু রাখীকে সম্মান করতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি নিজে আলেকজান্ডারকে আঘাত করেননি।
সম্রাট হুমায়ুন ও রানি কর্ণবতীর গল্প
একটি জনপ্রিয় গল্প থেকে জন্য যায়, ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে গুজরাতের সুলতান বাহাদুর শাহ চিতোর আক্রমণ করলে, রানি কর্ণবতী সাহায্যের প্রার্থনা চেয়ে হুমায়ুনকে একটি রাখী পাঠান। কর্ণবতীর রাখী প্রেরণে অভিভূত হয়ে হুমায়ুন চিতোর রক্ষা করার জন্য একদল সৈন্য প্রেরণ করেন। তবে হুমায়ুনের সৈন্য চিতর পোঁকছনোর আগেই বাহাদুর শাহ দুর্গ জয় করে নিয়েছিলেন। কথিত আছে বাহাদুর শাহের সেনাবাহিনীর হাত থেকে নিজেদের সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য ১৫৩৫ সালের ৮ মার্চ রানি কর্ণবতী ১৩,০০০ পুরস্ত্রীকে নিয়ে জহর ব্রত পালন করে আগুনে আত্মাহুতি দেন। এরপর চিতোরে পৌঁছে হুমায়ুন, বাহাদুর শাহকে দুর্গ থেকে উৎখাত করেন এবং কর্ণবতীর ছেলে বিক্রমজিৎ সিংকে সিংহাসনে বসান। তবে সমসাময়িক ঐতিহাসিকদের লেখা থেকে রাখি প্রেরণের কথা বিশেষ কিছু জানা যায় না। কোন কোন ঐতিহাসিক রাখি প্রেরনের ঘটনাটির সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেন তবে মধ্য-সপ্তদশ শতকের রাজস্থানী লোকগাঁথায় এর উল্লেখ আছে।
বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন
১৯০৫ সালের জুন মাসে ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জন বাংলাকে দুই ভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেন, যা ধর্মীয়ভাবে বাংলাকে বিভক্ত করার একটি প্রচেষ্টা ছিল।
১৯০৫ সালের আগস্ট মাসে এই বিভাজন পরিকল্পনা পাস হয়, যা ১৬ই অক্টোবর, ১৯০৫ তারিখে কার্যকর হয়।
বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার পর সমগ্র বাংলায় ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক প্রতিবাদ শুরু হয়। এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ অন্যান্য জাতীয়তাবাদী নেতারা এই বিভাজনের তীব্র সমালোচনা করেন এবং আন্দোলনের সূচনা করেন।
বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য এবং হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তুলতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “রাখী বন্ধন” উৎসব পালন করেন। এই উৎসবের মাধ্যমে তিনি সমস্ত সম্প্রদায়কে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি কলকাতা, ঢাকা ও সিলেট থেকে হাজার হাজার হিন্দু-মুসলিম ভাই-বোনকে রাখী বন্ধন উৎসবে অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই সময়ে একাধিক গান রচনা করেন যা জনগণের মধ্যে ঐক্য ও প্রতিরোধের মনোভাব জাগ্রত করতে সাহায্য করে। তাঁর লেখা গানগুলির মধ্যে “বাংলার মাটি বাংলার জল” অন্যতম।
বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন ও রাখী বন্ধন উৎসব অবশেষে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের পথ প্রশস্ত করে। এই উৎসব এখনও ঐক্য ও বিভাজনমূলক নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে।
রাখি বন্ধনের উদযাপন: রীতি ও আচার-অনুষ্ঠান
রাখি বন্ধন শুধুমাত্র একটি পবিত্র সুতোর বন্ধনে সীমাবদ্ধ নয়। এই উৎসবের মাধ্যমে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভালোবাসা ও স্নেহের আদান-প্রদান হয়। সকালে, পরিবারের সদস্যরা একত্রিত হন এবং রাখী বাঁধার অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুতি নেন। বোনেরা তাদের ভাইদের কপালে তিলক লাগিয়ে রাখী বেঁধে দেয়, এবং ভাইরা তাদের বোনদের সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়।
বোনেরা রাখী বাঁধার পর ভাইদের মিষ্টি খাওয়ান, এবং ভাইরা তাদের বোনদের উপহার দেন। উপহার হিসেবে নগদ অর্থ, পোশাক, গয়না বা অন্য কোন প্রয়োজনীয় জিনিস দেওয়া হয়। তবে, এই উপহারের মধ্যে সবচেয়ে মূল্যবান হল ভালোবাসা ও স্নেহের অনুভূতি।
আধুনিক যুগে রাখি বন্ধন: সামাজিক পরিবর্তন ও গুরুত্ব
আধুনিক যুগে রাখি বন্ধনের তাৎপর্য কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমান সমাজে, এই উৎসব শুধুমাত্র ভাই-বোনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। রাখী এখন বন্ধুত্ব, স্নেহ ও ভালোবাসার প্রতীক হয়ে উঠেছে। অনেক সময়, রাখী বন্ধুদের মধ্যে বা এমনকি প্রতিবেশীর মধ্যেও বিনিময় হয়, যেখানে সম্পর্কের সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
অনেক মানুষ এখন রাখীকে সামাজিক বন্ধন হিসেবে দেখে থাকেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন ও স্কুলে রাখী উৎসব পালন করা হয়, যেখানে সবাই একে অপরকে রাখী বেঁধে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে ঐক্যের বার্তা প্রদান করেন।
রাখি বন্ধনের অর্থনৈতিক প্রভাব
রাখি বন্ধনের সময় বিভিন্ন ধরণের পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায়, বিশেষত রাখীর চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ভারতের বিভিন্ন অংশে, বিশেষত রাজস্থান, গুজরাট এবং উত্তরপ্রদেশে রঙিন রাখীর তৈরি ও বিক্রয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও, মিষ্টি, পোশাক, উপহার সামগ্রী ও কার্ডের বিক্রিও উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পায়। পশ্চিমবঙ্গেও রাখি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদা এই সময় অনেক বেড়ে যায়।
ই-কমার্স সাইটগুলিও রাখী ও উপহার সামগ্রীর ক্রয়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। অনেক মানুষ এখন অনলাইনে রাখী ও উপহার কিনছেন এবং তাদের প্রিয়জনদের কাছে পাঠাচ্ছেন, বিশেষত যারা দূরে থাকেন। এই কারণে, রাখী উৎসবের সময় বিভিন্ন ই-কমার্স সাইটে বিশেষ অফার ও ছাড় দেওয়া হয়, যা ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে। মূলত রাখি উৎসব অর্থনীতিতে অনেকটা প্রভাব ফেলে।
রাখি বন্ধন: সাম্প্রতিক বছরগুলিতে পরিবর্তন
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে রাখি বন্ধনে কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। মহামারী পরিস্থিতির কারণে অনেক মানুষ অনলাইনে রাখী পাঠানো শুরু করেছেন। এছাড়াও, ইকো-ফ্রেন্ডলি রাখীর ব্যবহার বেড়েছে, যা পরিবেশ সংরক্ষণের প্রতি মানুষের সচেতনতা প্রদর্শন করে।
অনেক পরিবার এখন দুর থেকেই ভিডিও কলের মাধ্যমে রাখী বন্ধন উদযাপন করে, বিশেষত যারা বিভিন্ন দেশে বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। এই ধরণের উদযাপন শুধু দূরত্ব কমায় না, বরং প্রযুক্তির সহায়তায় সম্পর্কের মেলবন্ধনকে আরও দৃঢ় করে তোলে।
রাখি বন্ধন শুধুমাত্র একটি উৎসব নয়, এটি একটি আবেগ, একটি প্রতিশ্রুতি, এবং সম্পর্কের শক্তি। এই উৎসবের মাধ্যমে মানুষ একে অপরের সঙ্গে ভালবাসা ও স্নেহের সম্পর্ককে উদযাপন করে এবং সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়। যদিও যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এর উদযাপনে কিছু পরিবর্তন এসেছে, তবে রাখী বন্ধনের মূল সুর ও গুরুত্ব অপরিবর্তিত রয়েছে। প্রতিটি ভাই-বোনের সম্পর্কের মধ্যে রাখীর এই সুতোর বন্ধন চিরকাল অটুট থাকুক।