রথযাত্রা 2024: প্রাচীন উৎসবের আধুনিক রূপ
রথযাত্রা 2024
বলা হয় বাঙালির নাকি বারো মাসে তেরো পার্বণ তবে শুধু বাঙালি কেন গোটা ভারতবর্ষ জুড়েই সারা বছর প্রায় উৎসব লেগেই থাকে, তেমনি একটি উৎসব হল রথযাত্রা, যা আর কিছুদিনের মধ্যেই সারা ভারতবর্ষ জুড়ে পালন করা হবে। ভারতবর্ষের মূলত উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্ড এমনকি বাংলাদেশও এই রথযাত্রা প্রচন্ড ধুমধাম করে পালন করা হয়। এছাড়াও বর্তমানে ইসকনের বিশ্বব্যাপী প্রচারের মাধ্যমে সারা বিশ্বেই রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। তবে কি এই রথযাত্রা? কেনই বা পালন করা হয়? কোথা থেকে এর উৎপত্তি? এটা কি শুধুই পুরান নাকি ইতিহাস? সবটাই নিচে আলোচনা করা হলো।
ইতিহাস:
রথযাত্রার উৎপত্তি এবং ইতিহাস সম্পর্কে নানা পুরান ও লোককথা প্রচলিত আছে। আষাঢ় মাসে শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে পালিত হয় রথযাত্রা। কথিত আছে এই দিন বলরাম ও বোন সুভদ্রার সাথে মাসির বাড়ি অর্থাৎ ইন্দোদুম্নের পত্নী গুন্ডিচার বাড়ি যান জগন্নাথ, তারপর আবার সাত দিন পর মাসির বাড়ি থেকে মন্দিরে ফেরেন জগন্নাথ এই মাসির বাড়ি যাওয়া কে সোজা রথ এবং ফিরে আসাকে উল্টো রথ হিসাবে পালন করা হয়।
এই রথযাত্রা নিয়ে আরও বেশ কিছু লোক কথা বা কাহিনী প্রচলিত আছে। যেমন- একটি কাহিনী অনুযায়ী জৈষ্ঠ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে জগন্নাথকে স্নান করানো হয়। তারপর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন, এরপর ১৫ দিন তাকে সেবা শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলা হয়, এবং আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে তিনি একান্তবাস সমাপ্ত করে সকলকে দর্শন দেন। অনেকদিন পর জগন্নাথের দর্শন পেয়ে সকলে প্রচন্ড আনন্দিত হয় এবং তারা রথযাত্রার আয়োজন করে। আরেকটি পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে বলা হয় সুভদ্রা দ্বারোকা দর্শনের ইচ্ছা প্রকাশ করলে তিনটি পৃথক পৃথক রথে সুভদ্রা, কৃষ্ণ এবং বলরাম নগর পরিদর্শনে বের হন এখান থেকেই প্রতিবছর রথযাত্রার প্রচলন হয়।
আরো একটি লোককথা অনুযায়ী ইহলোক ত্যাগের পর কৃষ্ণের সঙ্গে বলরাম সুভদ্রার পার্থিব শরীর সমুদ্র তীরে দাও সংস্কার করা হয় কিন্তু সে সময় সমুদ্র তীরে প্রবন্ধ প্রবল ঝড়ের বেগে দ্বারকাধীশ এর অর্ধ দগ্ধ শব সমুদ্রে প্রবাহিত হয়ে পুরী পৌঁছয়।পুরীর রাজা সেই তিন শব তুলে পৃথক পৃথক রথে বিরাজমান করান। নগরের লোকেরা সেই রথ টেনে সারা নগর ঘোরান। দারু কাঠ শবের সঙ্গে প্রবাহিত হয়ে এসেছিল। সেই কাঠ দিয়ে বাক্স তৈরি করে তাদের শব রেখে ভূমিতে সমর্পিত করে দেয়া হয়। চারণ পুস্তক অনুযায়ী এরপর থেকেই প্রতিবছর রথযাত্রা পালিত হতে শুরু হয়।
রথযাত্রার আয়োজন ও প্রস্তুতি:
ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ অনুযায়ী কৃষ্ণ তার ভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যন্মুর সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে সমুদ্র তীরে ভেসে আসা একটি কাষ্ঠ খন্ড দিয়ে তার মূর্তি নির্মাণের নির্দেশ দেন। রাজা তখন একজন উপযুক্ত কাষ্ঠ শিল্পীর সন্ধান করতে থাকেন এবং তার সামনে তখন হাজির হন এক রহস্যময় বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ এবং তিনি রাজার কাছ থেকে মূর্তি নির্মাণের জন্য কয়েকদিন সময় চেয়ে নেন। রাজা রানী বাইরে অপেক্ষা করতে থাকেন ভেতর থেকে মূর্তি নির্মাণের শব্দ তাদের কানে আসতে থাকে কিন্তু একদিন তারা অধৈর্য হয়ে দরজা খুলে ফেলেন এবং দেখেন যে মূর্তির কাজ অসমাপ্ত এবং সেই কাষ্ঠ শিল্পীও উধাও, আসলে এই রহস্যময় কাস্য শিল্পী ছিলেন আসলে দেব বিশ্বকর্মা, মূর্তির হস্তপদ তখনও নির্মিত হয়নি দেখে রাজা বিমর্ষ হয়ে পড়েন ,কাজে বাধা ধানের জন্য রাজা অনুতাপ প্রকাশ করতে থাকে তখন দেবশ্রী নারদ তার সম্মুখে উপস্থিত হন এবং তাকে সান্তনা দিয়ে বলেন এই যে অর্ধসমাপ্ত মূর্তি, এই মূর্তিই পরমেশ্বরের এক স্বীকৃত স্বরূপ এই রূপেই তিনি তার পূজা করতে বলেন।
শাস্ত্রমতে প্রতিবছর নিম কাঠ দিয়ে জগন্নাথ সুভদ্রা ও বলরামের রথ নির্মাণ করা হয়। এবং যে রথে তারা প্রতি বছর নগর যাত্রায় বের হন তার একটি বিশেষ বিশেষ নাম ও গুরুত্ব রয়েছে। প্রতিটি রথের উচ্চতা ও নির্মাণশৈলী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রথ গুলি সুন্দরভাবে সাজানো হয় এবং এগুলি দেখতে লাখ লাখ ভক্ত সমবিত হয়।
জগন্নাথ:
জগন্নাথ কথাটি এসেছে জগৎ ও নাথ এই দুটি শব্দ থেকে, যার অর্থ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ঈশ্বর যিনি। জগন্নাথ যে রথে করে নগরযাত্রায় বের হন লাল ও হলুদ রঙের সেই রথের নাম নন্দী ঘোষ। যা প্রায় ৪৫ ফুট এবং রথটি ১৬ চাকার।এই রথের মাথায় যে পতাকা লাগানো থাকে তার নাম ত্রৈলোক্য মোহন, রথের সারথি দারুকা ও রক্ষক গরুর। আর যে রশি দিয়ে জগন্নাথের রথ টানা হয় সেই রশিটির নাম শঙ্খচুর।
বলরাম:
বলরাম যে রথে করে নগরযাত্রায় বের হন সেই রথের নাম তালধ্বজ। এই রথের রক্ষক বাসুদেব সারথি মাতালি ও যে রশি দিয়ে রথটি টানা হয় তার নাম স্বর্ণচূড়া। এই রথটি লাল নীল ও সবুজ রঙের হয়ে থাকে এবং প্রায় ৪৩ ফুট উঁচু এবং ১৪ চাকা বিশিষ্ট। এই রথের চূড়ায় যে পতাকা লাগানো থাকে তার নাম উনানি।
সুভদ্রা:
সুভদ্রা যে রথে করে নগর পরিক্রমণে বের হন , লাল ও কালো রংয়ের ৪২ ফুট উঁচু ও ১২ চাকার রথটির নাম দেবদোলন। রথটির রক্ষক জয়দুর্গা সারথি অর্জুন ও রশির নাম স্বর্ণচূড়া। এই রথের মাথায় যে পতাকা লাগানো থাকে তার নাম নন্দীক।
উৎসবের দিন:
রথযাত্রার দিন ভগবান জগন্নাথ বলরাম ও সুভদ্রা মন্দির থেকে বাহির হন এবং ভক্তরা রথের দড়ি টেনে তাদের গুন্ডিচা মন্দির পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। যা কিনা জগন্নাথ দেবের মাসির বাড়ি। এই সময়ে ধর্মীয় গান প্রার্থনা আচার অনুষ্ঠান পালন করা হয়, বিশ্বাস করা হয় যে রথযাত্রায় সম্পূর্ণভাবে অংশগ্রহণ করলে জীবন মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। রথযাত্রা উপলক্ষে দেশ এবং রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় মেলা আয়োজন করা হয়। বিদেশেও বিভিন্ন জায়গায় পালন করা হয় এই রথযাত্রার উৎসব।
ভিন্ন ভিন্ন স্থানের রথযাত্রা:
ভারতের বিভিন্ন স্থানে এই রথযাত্রা উৎসব পালিত হয়।হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী 2024 সালের আষাঢ় মাসের শুক্লাপক্ষের দ্বিতীয়া তিথির সূচনা হবে 7 জুলাই সকাল 4টে 26মিনিটে। এই তিথি সমাপ্ত হবে 8 জুলাই সকাল 4টে 59 মিনিটে। উদয়া তিথি অনুযায়ী ৭ জুলাই রথযাত্রা পালিত হবে।
পুরীর রথযাত্রা:
বিশ্বের সবচেয়ে বড় রথযাত্রা পালন করা হয় পুরীতেই এখানে প্রতি বছর লাখে লাখে মানুষ ভিড় জমায় এই রথযাত্রা উৎসব দেখার জন্য এখানে অংশগ্রহণ করার জন্য।
মাহেশের রথযাত্রা:
পুরীর রথযাত্রার পর ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম রথযাত্রা হল মাহেশের রথযাত্রা। ১৩৯৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এটি পালিত হয়ে আসছে পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুরের মহেশে। জগন্নাথ সুভদ্র বলরামের রথের সাথে যুক্ত লম্বা রশি টানার জন্য হাজারে হাজারে মানুষ ভিড় জমায় মনে করা হয় এই রশি স্পর্শ করাও অনেক পুণ্যের।
এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় এই রথযাত্রা উৎসব ধুমধাম করে পালন করা হয়, প্রায়ই বাড়িতে ছোট ছোট রথ তৈরি করে সেগুলো টানা হয়। ছোট থেকে বড় সবাই এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে।
বিদেশের রথযাত্রা:
বাংলাদেশেও এই রথযাত্রা উৎসব পালন করা হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রথযাত্রা পালন করা হয় ধামরাইয়ে, ধামরাই রথযাত্রা। ঢাকা ইসকনের রথযাত্রা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম।
এছাড়াও আমেরিকা ইংল্যান্ড অস্ট্রেলিয়া সহ বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় এই রথযাত্রা উৎসব পালন করা হয়। জায়গা অনুসারে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রীতিতে রথযাত্রা পালন করা হলেও মূল আচার গুলি একই থাকে।
আর্থসামাজিক প্রভাব:
রথযাত্রার সময় পুরী সহ বিভিন্ন রথযাত্রার স্থানগুলিতে উৎসবে অংশগ্রহণ করার জন্য লাখে লাখে ভক্তরা ভিড় জমায় যা স্থানীয় অর্থনীতিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে। স্থানীয় ব্যবসা, হোটেল, রেস্তোরাঁ, বিশেষভাবে এই সময় লাভবান হয়। পর্যটন শিল্প এর দ্বারা উল্লেখযোগ্য ভাবে উপকৃত হয়। ভক্তদের উপস্থিতি স্থানীয় ব্যবসায় উল্লেখযোগ্য ভাবে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
রথযাত্রা শুধুমাত্র ভারতের একটি ধর্মীয় উৎসব নয় এটি ভারতের সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের একটি অন্যতম নিদর্শন। যা এখন কেবল ভারতেই সীমাবদ্ধ নেই, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও এই উৎসব ছড়িয়ে গেছে। এই উৎসব ভক্তদের মধ্যে সেবা সম্প্রীতি ও আধ্যাত্মিকতার বাণী প্রচার করে। রথযাত্রা ভারতবর্ষের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি মূল্যবান অংশ। যা সমাজে একতা ও শান্তির বার্তা প্রচার করে।
Pingback: রাখি বন্ধন: স্নেহ, সুরক্ষা ও সম্পর্কের এক গভীর মেলবন্ধন - Pratibedan