SpaDeX মিশন: মহাকাশে ভারতের নিজস্ব স্পেস স্টেশন নির্মাণে ঐতিহাসিক অভিযান
ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ISRO) আরেকটি নতুন মাইলফলক ছোঁয়ার জন্য প্রস্তুত। ডিসেম্বরে চালু হওয়া PSLV-C60 মিশনের মাধ্যমে ISRO তাদের Space Docking Experiment (SpaDeX) পরিচালনা করছে। এটি ভবিষ্যতে ভারতের নিজস্ব মহাকাশ স্টেশন তৈরির পথে এক বড় পদক্ষেপ।
SpaDeX মিশন কী এবং এর গুরুত্ব:
SpaDeX বা Space Docking Experiment হল দুটি কৃত্রিম উপগ্রহের docking, interlocking, এবং undocking প্রযুক্তির পরীক্ষামূলক কার্যক্রম। এটি মহাকাশে একটি জটিল এবং সূক্ষ্ম প্রক্রিয়া। সফল docking ভারতের মহাকাশ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে একটি ঐতিহাসিক সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হবে। এই মিশন ভবিষ্যতে চন্দ্রযান ৪-এর মতো অভিযানে সহায়ক হবে এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে ভারত তার নিজস্ব মহাকাশ স্টেশন Bharatiya Antriksh Station (ভারতীয় আন্তরিক্ষ স্টেশন) প্রতিষ্ঠার জন্য এক ধাপ এগিয়ে যাবে।
বর্তমানে, মহাকাশে docking করার ক্ষমতা মাত্র তিনটি দেশের রয়েছে – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, এবং চীন। SpaDeX সফল হলে ভারত এই প্রযুক্তি অর্জনকারী বিশ্বের চতুর্থ দেশ হবে।
স্পাডেক্স মিশনের প্রযুক্তিগত দিক
SpaDeX মিশনে দুটি ছোট স্যাটেলাইট – SDX01 (Chaser) এবং SDX02 (Target) – প্রেরণ করা হয়েছে। PSLV-C60 রকেট 10PM IST-তে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটা থেকে উৎক্ষেপিত হয়। ১৫.২ মিনিটে স্যাটেলাইট দুটি সঠিক কক্ষপথে স্থাপন করা হয়। পরবর্তী কয়েক দিনে এই দুটি স্যাটেলাইট পরস্পরের থেকে ২০ কিমি দূরত্বে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং ৭ জানুয়ারি ২০২৫-এ docking সম্পন্ন করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট:
বর্তমানে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীন মহাকাশে ডকিং প্রযুক্তি সম্পন্ন করেছে। SpaDeX মিশনের সাফল্যের মাধ্যমে ভারত এই এলিট ক্লাবে চতুর্থ দেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে, যা দেশের মহাকাশ গবেষণায় একটি বিশাল মাইলফলক।
মহাকাশ স্টেশন নির্মাণে ডকিং প্রযুক্তির ভূমিকা:
মহাকাশ স্টেশন নির্মাণে ডকিং প্রযুক্তি অপরিহার্য, কারণ এটি বিভিন্ন মডিউলকে মহাকাশে সংযুক্ত করতে সহায়তা করে। SpaDeX মিশনের মাধ্যমে ইসরো এই প্রযুক্তির দক্ষতা অর্জন করবে, যা ভবিষ্যতে ভারতের মহাকাশ স্টেশন নির্মাণে সহায়ক হবে।
ডকিং প্রক্রিয়ার মূল উদ্দেশ্য হল:
1. রেন্ডেভাস এবং ডকিং প্রযুক্তির উন্নয়ন: মহাকাশে দুটি কৃত্রিম উপগ্রহ docking এবং undocking-এর মাধ্যমে এই প্রযুক্তির কার্যকারিতা প্রমাণ করা।
2. বিদ্যুৎ স্থানান্তরের পরীক্ষা: ডকিং করা স্যাটেলাইটের মধ্যে বিদ্যুৎ স্থানান্তর করে ভবিষ্যতে মহাকাশ রোবোটিক্স-এর জন্য প্রযুক্তি উন্নত করা।
3. কম্পোজিট স্পেসক্রাফট নিয়ন্ত্রণ: মহাকাশে এবং মিশন কন্ট্রোল থেকে স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা বৃদ্ধি।
4. ডকিংয়ের পরে পেলোড অপারেশন: কৃত্রিম উপগ্রহগুলোর Payload পরিচালনার দক্ষতা নিশ্চিত করা।
স্পাডেক্স মিশন এবং চন্দ্রযান ৪-এর সংযোগ:
SpaDeX মিশন কেবল মহাকাশ স্টেশন তৈরির জন্য নয়, বরং ভবিষ্যতের চন্দ্র মিশনের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ISRO ভবিষ্যতে আরও জটিল মহাকাশ অভিযান পরিচালনা করতে পারবে।
POEM-4 মডিউল এবং মাইক্রোগ্রাভিটির পরীক্ষা:
SpaDeX-এর পাশাপাশি, ISRO তাদের PSLV-এর চতুর্থ স্তরকে POEM-4 (PSLV Orbital Experimental Module) হিসেবে ব্যবহার করছে। এটি মহাকাশে মাইক্রোগ্রাভিটি সংক্রান্ত গবেষণার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম সরবরাহ করে। POEM-4-এ মোট ২৪টি Payload রয়েছে, যার মধ্যে ১৪টি ISRO কেন্দ্র এবং ১০টি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও স্টার্ট-আপ থেকে নেওয়া হয়েছে।
এই গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল রোবোটিক আর্ম। এটি মহাকাশ স্টেশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে এটি tethered debris capture-এর জন্য পরীক্ষা করা হচ্ছে।
বিশ্বের অন্যান্য মহাকাশ স্টেশন এবং ভারতের অবস্থান:
বর্তমানে পৃথিবীতে দুটি মহাকাশ স্টেশন রয়েছে:
1.আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (ISS): এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের NASA এবং রাশিয়ার Roscosmos-এর যৌথ উদ্যোগে তৈরি। ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি (ESA)-ও এর সাথে যুক্ত।
2. “তিয়ানগং মহাকাশ স্টেশন”, এটি চীনের নিজস্ব মহাকাশ স্টেশন।
ভারত ২০৩৫ সালের মধ্যে তার “ভারতীয় আন্তরিক্ষ স্টেশন” প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছে। SpaDeX-এর মতো মিশন এই লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে অত্যন্ত সহায়ক।
স্পাডেক্স মিশন: ভবিষ্যতের সম্ভাবনা:
SpaDeX মিশনের সফলতা ভারতের মহাকাশ গবেষণায় এক নতুন যুগের সূচনা করবে। এটি ISRO-এর রিয়ুজেবল লঞ্চ ভেহিকেল (RLV)-এর জন্য ডকিং প্রযুক্তি উন্নত করার ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে। ISRO চেয়ারম্যান এস. সোমনাথ জানিয়েছেন, “আমরা ৭ জানুয়ারির জন্য docking পরিকল্পনা করেছি। এটি সফল হলে এটি ভারতের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন হবে।”
SpaDeX কেবল একটি মিশন নয়, এটি ভারতের মহাকাশ গবেষণার উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতীক। মহাকাশ স্টেশন তৈরির পাশাপাশি, এটি আন্তঃগ্রহ মিশনের জন্য ভারতের ক্ষমতা প্রমাণ করবে। এই মিশন শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত দক্ষতার প্রদর্শন নয়, এটি ভারতের মহাকাশ গবেষণায় আত্মনির্ভরতার দৃষ্টান্ত। এই মিশন সফল হলে এটি ভারতের মহাকাশ ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। ৭ জানুয়ারি ২০২৫, সম্ভবত ভারতীয় মহাকাশ গবেষণার একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।