নৌবাহিনীতে পুনরাবৃত্তি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা: কারণ বিশ্লেষণ।
মুম্বাই নৌঘাঁটিতে সংস্কারকার্য চলাকালীন রনতরী আইএনএস ব্রহ্মপুত্রে আগুন লেগে যায়। নৌবাহিনী জানিয়েছে, জাহাজটি এক পাশে উল্টে গেছে।
আইএনএস ব্রহ্মপুত্র ভারতীয় নৌবাহিনী একটি যুদ্ধজাহাজ, যা মুম্বাই নৌঘাঁটিতে রক্ষণাবেক্ষণের অধীনে ছিল। রবিবার সন্ধ্যায় আইএনএস ব্রহ্মপুত্রে আগুন লেগে যায়। একজন জুনিয়র নাবিক নিখোঁজ এবং উদ্ধারকারী দল তাকে খুঁজছে। নৌবাহিনী জানিয়েছে যে অন্যান্য সকল কর্মী নিরাপদে রয়েছে। দুর্ঘটনা তদন্তের জন্য ভারতীয় নৌবাহিনী একটি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।
নৌবাহিনী একটি বিবৃতিতে বলেছে, সোমবার সকালে জাহাজের ক্রু এবং মুম্বাই বন্দরে থাকা অন্যান্য জাহাজের অগ্নিনির্বাপক দলের সহায়তায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। পরে আর কোথাও যাতে আগুন না ছড়িয়ে পড়ে তাই, স্যানিটাইজেশন চেক সহ অন্যান্য দরকারি কিছু কর্মসূচি পরিচালিত হয়।
নৌবাহিনী জানিয়েছে যে, দুপুরে জাহাজটি এক পাশে হেলে পড়তে শুরু করে। সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, জাহাজটি সোজা অবস্থানে আনা আর সম্ভব হয়নি। জাহাজটি তার নোঙ্গরের পাশেই আরও হেলে পড়ে এবং বর্তমানে এক পাশেই হেলে আছে জাহাজটি।
আইএনএস ব্রহ্মপুত্র প্রথম দেশীয়ভাবে নির্মিত ‘ব্রহ্মপুত্র’ শ্রেণীর ক্ষেপণাস্ত্র পরিচালিত রণতরী। এটি ২০০০ সালের এপ্রিল মাসে ভারতীয় নৌবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জাহাজটি পরিচালিত হয় ৪০ জন অফিসার এবং ৩৩০ জন নাবিক দ্বারা ।
জাহাজটি বিমানবিরোধী রকেট, রাডার,মাঝারি দূরত্বের ও কাছাকাছি দূরত্বের এবং ভূমি থেকে ভূমিতে এবং ভূমি থেকে আকাশে মিসাইল এবং টর্পেডো লঞ্চার দিয়ে সজ্জিত। জাহাজটির বিভিন্ন প্রকারের সেন্সর রয়েছে যা সামুদ্রিক যুদ্ধের সমস্ত দিককে কভার করে এবং এটি সিকিং এবং চেতক হেলিকপ্টার পরিচালনা করতে সক্ষম। রণতরীটির দৈর্ঘ্য ১২৫ মিটার এবং এর প্রস্থ ১৪.৪ মিটার, যা সর্বাধিক ৩০ নটের গতিতে চলতে সক্ষম। আইএনএস ব্রহ্মপুত্রকে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও তা কিন্তু অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং হবে।
কেন ভারতের যুদ্ধজাহাজ গুলো সহজেই আগুনের কবলে পড়ে?
বছরের পর বছর ধরে, ভারতীয় নৌবাহিনী তার জাহাজ এবং সাবমেরিনে বেশ কয়েকবার আগুনের ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে, যা নিরাপত্তা প্রোটোকল, রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিচালন পদ্ধতি সম্পর্কে গুরুতর উদ্বেগ উত্থাপন করেছে। এই ঘটনাগুলি নৌবাহিনীর কার্যকরী প্রস্তুতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতিকরণ এবং নীতিগত পরিবর্তনের দিকে পরিচালিত করছে।
আইএনএস সিন্ধুরক্ষক (২০১৩)
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল ১৪ আগস্ট, ২০১৩ সালে, যখন কিলো-শ্রেণীর সাবমেরিন আইএনএস সিন্ধুরক্ষকে একাধিক বিস্ফোরণ এবং একটি বিশাল আগুনের মুখোমুখি হয় মুম্বাইতে ডক করা অবস্থায়। সাবমেরিনটি তখন সম্পূর্ণরূপে অস্ত্রসজ্জিত ছিল এবং তা ডুবে যায়, যার ফলে ১৮ জন নৌ কর্মীর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। এই ঘটনাটি মূলত মানবিক ত্রুটির কারণে টর্পেডো সেকশনে অভ্যন্তরীণ বিস্ফোরণের জন্য দায়ী ছিল। এই বিপর্যয়টি নৌবাহিনীর সাবমেরিন বিভাগটিতে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করেছিল এবং সাবমেরিনে গোলাবারুদ পরিচালনার জন্য নিরাপত্তা প্রোটোকলের উপর গুরুতর প্রশ্ন তুলেছিল।
আইএনএস কঙ্কণ (২০১৩)
৪ ডিসেম্বর, ২০১৩ সালে, মাইনসুইপার আইএনএস কঙ্কনে বিশাখাপত্তনমে ডক করা অবস্থায় আগুন লেগে যায়। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছিল, কিন্তু জাহাজটি উল্লেখযোগ্য ভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তদন্তে শর্ট-সার্কিট এবং অনুপযুক্ত অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থাকে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এই দুর্ঘটনাটি নৌবাহিনীর বহরে থাকা অন্যান্য জাহাজগুলির অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা এবং সরঞ্জামগুলির পুনর্বিবেচনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
আইএনএস সিন্ধুরত্ন (২০১৪)
২০১৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি, আরেকটি গুরুতর ঘটনা ঘটে, যখন আইএনএস সিন্ধুরত্ন, একটি কিলো-শ্রেণীর সাবমেরিন, মুম্বাই উপকূলে একটি রুটিন প্রশিক্ষণ অনুশীলন পরিচালনা করছিল। কেবলগুলিতে একটি বৈদ্যুতিক আগুন ধরে যায়, যার ফলে পুরো সাবমেরিনটি ধোঁয়ায় ঢেকে যায়। দুর্ভাগ্যবশত, দুই নৌ-কর্মী তাদের জীবন হারান এবং বেশ কয়েকজন ক্রু ধোঁয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়ে। এই ঘটনাটি তৎকালীন প্রধান নৌসেনাপতি ডি কে যোশির পদত্যাগের দিকে নিয়ে যায়, যিনি এই দুর্ঘটনার জন্য নৈতিক দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
আইএনএস বিরাট (২০১৬)
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে, মুম্বাই ডকইয়ার্ডে ওয়েল্ডিং অপারেশন চলাকালীন অনুমোদিত এয়ারক্রাফ্ট ক্যারিয়ার আইএনএস বিরাটে একটি ছোট আগুন লাগে। যদিও আগুনটি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছিল, কিন্তু এটি অবসরপ্রাপ্ত জাহাজগুলিতেও কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছিল।
আইএনএস বেতোয়া (২০১৬)
২০১৬ সালের ৫ ডিসেম্বর মুম্বাইতে আনডকিং করার সময় গাইডেড মিসাইল রনতরী আইএনএস বেতোয়া একটি বড় দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়। ডক-ব্লক ব্যর্থতার কারণে রনতরীটি উল্টে যায়, যার ফলে ২ জনের মৃত্যু এবং ১৪ জন আহত হন। এই ঘটনা নৌবাহিনীর জাহাজ পরিচালনা পদ্ধতি এবং ডক সুরক্ষা অনুশীলন সম্পর্কে উদ্বেগ বাড়িয়ে তোলে।
আইএনএস শিবালিক (২০১৮)
২০১৮ সালের ১০ জানুয়ারি কারওয়ার নৌঘাঁটিতে আরেকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে আইএনএস শিবালিকের ইঞ্জিন রুমে। তেল লিকেজের কারণে আগুন ধরে যায়। যদিও আগুন বড় ধরনের ক্ষতি ছাড়াই নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল, তবুও এই ধরনের ঘটনা উন্নত জাহাজগুলির এমন ঝুঁকির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
আইএনএস রনবীর (২০২২)
সাম্প্রতিক সময়ে, ২০২২ সালের ১৮ জানুয়ারি, মুম্বাইয়ের নৌ ডক ইয়ার্ডে আইএনএস রনবীরে একটি বিস্ফোরণের কারণে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এই ঘটনায় ৩ নৌ কর্মীর মৃত্যু হয় এবং ১১ জন আহত হন। বিস্ফোরণটি সম্ভবত এয়ার-কন্ডিশনিং সিস্টেমের ত্রুটির কারণে ঘটে।
আইএনএস সহ্যাদ্রি (২০২৩)
২০২৩-এর মার্চে, আইএনএস সহ্যাদ্রি ভারতীয় মহাসাগরে রুটিন টহল মিশনের সময় ইঞ্জিন রুমে আগুন ধরে যায়। এই অগ্নিকাণ্ডটি জ্বালানি লাইনের একটি প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে ঘটে।
ভারতীয় নৌবাহিনীতে অগ্নিকাণ্ডের কারণসমূহ:
ভারতীয় নৌবাহিনীতে অগ্নিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি মূলত কয়েকটি কারণে ঘটে:
- প্রথমত, পুরানো নৌবহর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগের বিষয়, কারণ সাবমেরিন আইএনএস সিন্ধুরক্ষক এবং আইএনএস সিন্ধুরত্নের মতো অনেক জাহাজ দুই দশকেরও বেশি পুরানো এবং যান্ত্রিক ব্যর্থতার ঝুঁকিতে রয়েছে।
- দ্বিতীয়ত, রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি। প্রায়শই বাজেট সীমাবদ্ধতা, যার ফলে অপারেশনাল সুরক্ষা এবং প্রস্তুতিতে প্রভাব ফেলে এবং বিলম্ব হয়।
- তৃতীয়ত, মানব ত্রুটি, বিশেষত পদ্ধতিগত ত্রুটিগুলি বারবার সমস্যার সৃষ্টি করে, যেমনটি সিন্ধুরক্ষক এবং সিন্ধুরত্ন ঘটনাগুলিতে দেখা গেছে।
- চতুর্থত, বৈদ্যুতিক সিস্টেম এবং ইঞ্জিনে ত্রুটির মতো প্রযুক্তিগত ব্যর্থতাগুলিকে আগুনের কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে ব্যাটারি ব্যর্থতা এবং শর্ট সার্কিট পুনরাবৃত্তি সমস্যা হিসেবে দেখা গেছে।
- সর্বশেষে, নিরাপত্তা প্রোটোকল এবং আগুন নিয়ত্রনের ব্যবস্থা উভয়ই জাহাজে ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য পুনরায় পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলি ভারতীয় নৌ-বাহিনীর কার্যকারিতা কে বাধাপ্রাপ্ত করে।
আইএনএস সিন্ধুরক্ষকের মতো সম্পদের ক্ষতি নৌবাহিনীর সক্ষমতাকে কমিয়ে দেয় এবং কৌশলগত ত্রুটি দেখা দেয়। ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজ মেরামত এবং প্রতিস্থাপনের আর্থিক ব্যয় নৌবাহিনীর নির্ধারিত বাজেটে চাপ সৃষ্টি করে যার ফলে আধুনিকীকরণ ব্যাহত হয়। কর্মীদের উপর মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব পড়ে যা নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপর আস্থা কমাতে পারে। যা মনোবল এবং অপারেশনাল দক্ষতাকে প্রভাবিত করে। এছাড়াও জাহাজগুলি মেরামতের সময় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা রক্ষণাবেক্ষণ ব্যাহত হয়। বিষয়গুলির সমাধান দ্রুত প্রয়োজনীয়।