নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়: ঐতিহ্যের পুনর্জন্ম ও আধুনিকীকরণ
নালন্দা—এমন একটি নাম যা শুধু প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষা এবং জ্ঞানের ইতিহাসেই নয় সারা বিশ্বের কাছে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একসময় পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিচিত এই বিশ্ববিদ্যালয় কেবল ভারত নয়, পুরো এশিয়া এবং তার বাইরের দেশগুলোর শিক্ষার্থীদেরও আকর্ষণ করেছিল। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের পুনরুজ্জীবন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। তবে তার জন্য প্রাচীন নালন্দার ধ্বংসের পর প্রায় ৮০০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে, এবং আজ নতুন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় তার পুরোনো গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য প্রস্তুত।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস: প্রাচীন বিদ্যাপীঠের রূপকথা
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ৫ম থেকে ৬ষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যে শুরু হয়েছিল, যখন গুপ্ত সাম্রাজ্যের সম্রাট কুমারগুপ্ত এটি প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে বৌদ্ধধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, এবং গণিতসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর উচ্চতর শিক্ষা প্রদান করা হত। প্রায় ১০,০০০ শিক্ষার্থী এবং ২,০০০ শিক্ষক একত্রে বসবাস করতেন এবং অধ্যয়ন করতেন এই বিদ্যাপীঠে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে চীনের বিখ্যাত পর্যটক এবং গবেষক হুয়ানজাং এবং ই-জিং-এর মতো ব্যক্তিত্বরা ছিলেন, যারা এখানে বিদ্যা অর্জন করে নিজেদের দেশে জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছিলেন
বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি এতই ব্যাপক ছিল যে, শুধুমাত্র ভারত থেকেই নয়, চীন, জাপান, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, এবং অন্যান্য এশীয় দেশ থেকেও শিক্ষার্থীরা এখানে শিক্ষালাভ করতে আসত। নালন্দার পাঠ্যক্রমের মধ্যে ধর্ম, চিকিৎসাবিজ্ঞান, ভাষাতত্ত্ব, এবং বৌদ্ধ শিক্ষার ওপর গভীর মনোযোগ দেওয়া হত। এই বিশাল জ্ঞানকেন্দ্রের মধ্যে একটি প্রধান অংশ ছিল এর গ্রন্থাগার, যা “ধর্মাগঞ্জ” নামে পরিচিত। এখানে থাকা অমূল্য পাণ্ডুলিপির সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, এটি কয়েক মাস ধরে পুড়ে শেষ হয়েছিল তুর্কি আক্রমণের সময়।
নালন্দার ধ্বংস ও পুনর্জন্ম
১২০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে আফগান তুর্কি জেনারেল বখতিয়ার খিলজি আক্রমণ চালিয়ে নালন্দাকে ধ্বংস করেন। এই সময়ে নালন্দার অসংখ্য পাণ্ডুলিপি পুড়ে যায় এবং প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ৮০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নালন্দার গৌরব ইতিহাসের পাতায় চাপা পড়ে থাকে, কিন্তু ২১শ শতাব্দীতে ভারত সরকার এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের উদ্যোগে নালন্দা পুনরুজ্জীবিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়।
২০১০ সালে, ভারত সরকার এবং পূর্ব এশিয়া সামিট (EAS)-এর দেশগুলোর সহায়তায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করা হয়। ২০১৪ সালে শুরু হয় এর পুনর্গঠন কার্যক্রম, এবং বর্তমানে ২০২৪ সালে নালন্দার নতুন ক্যাম্পাস উদ্বোধন করা হয়েছে। এই নতুন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় একটি আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে, যেখানে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির মাধ্যমে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করা হয়েছে।
নতুন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাসটি অত্যন্ত আধুনিক এবং পরিবেশবান্ধব। এটি একটি ‘নেট জিরো’ গ্রিন ক্যাম্পাস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার অর্থ হলো এই ক্যাম্পাসের বিদ্যুৎ এবং জল এর ব্যবস্থাপনাসহ সব ধরনের প্রয়োজন স্থানীয়ভাবে মেটানো হয়। সৌরশক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, এবং জলের পুনর্ব্যবহার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। এছাড়াও এখানে ১০০ একর জলাশয়, একটি আন্তর্জাতিক কেন্দ্র, ক্রীড়া কমপ্লেক্স, এবং একটি ২,০০০ আসনবিশিষ্ট অ্যাম্ফিথিয়েটারও রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০টি শ্রেণিকক্ষসহ দুটি একাডেমিক ব্লক, দুটি ৩০০ আসনের অডিটোরিয়াম, এবং ৫৫০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একটি হোস্টেল রয়েছে। এখানে একটি আন্তর্জাতিক শিক্ষাব্যবস্থার পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থী এবং গবেষকরা এসে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারেন। এই নতুন প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য হলো ভারত ও বিশ্বের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং আন্তর্জাতিক গবেষণার একটি কেন্দ্র হিসেবে কাজ করা।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পিছনে ভারতের পাশাপাশি পূর্ব এশিয়া সামিটের (EAS) সদস্য দেশগুলোরও বড় ভূমিকা রয়েছে। জাপান, চীন, থাইল্যান্ড, কোরিয়া এবং অন্যান্য দেশগুলি এই উদ্যোগে অংশ নিয়েছে। পূর্বের মতোই, নতুন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র ভারতের শিক্ষার্থীদের জন্য নয়, এশিয়া এবং বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের জন্যও এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে কাজ করছে।
নালন্দার পুরোনো ঐতিহ্যকে ধরে রেখে এখানে আধুনিক বিষয়গুলিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সমাজবিজ্ঞান, এবং পরিবেশবিজ্ঞানসহ বিভিন্ন শাখায় উচ্চতর শিক্ষা এবং গবেষণা এখানে প্রাধান্য পাবে।
নালন্দার ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। সরকারের পরিকল্পনা অনুসারে, এটি কেবলমাত্র একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বরং একটি গ্লোবাল ইনোভেশন সেন্টার হিসেবে গড়ে উঠবে, যা বিভিন্ন দেশের গবেষকদের একত্রিত করবে। বিশ্বমানবতার কল্যাণে গবেষণা এবং শিক্ষার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার লক্ষ্য নিয়ে এটি কাজ করছে।
নতুন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশবান্ধব শিক্ষা এবং গবেষণার ক্ষেত্রে অগ্রগামী হবে। এখানকার ক্যাম্পাসে জল পুনর্ব্যবহার, সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার এবং স্থানীয়ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে উদাহরণ তৈরি করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এই ধরনের পরিবেশবান্ধব ক্যাম্পাস মডেল হিসেবে বিশ্বব্যাপী অনুসরণ করা যেতে পারে।
নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা, ধ্বংস এবং পুনর্জন্ম ভারতের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রাচীন নালন্দার গৌরব আজকের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে আবার জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এটি শুধু ভারতের নয়, বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। নালন্দার শিক্ষাব্যবস্থা, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি, এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা একে বিশ্বের মধ্যে একটি অন্যতম গ্লোবাল শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবে।