বিদায় “গব্বর”: ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম সেরা হোয়াইট-বল ওপেনারের অবসর
ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম সেরা হোয়াইট-বল ওপেনার শিখর ধাওয়ান আন্তর্জাতিক ও ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে অবসর ঘোষণা করলেন।
৩৮ বছর বয়সী ধাওয়ান যদিও ভারতীয় দলে আর খেলবেন না, তবে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন আইপিএল সহ লিগ ক্রিকেটে খেলা চালিয়ে যাওয়ার। ধাওয়ান তার শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচটি খেলেছিলেন ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে একটি ওয়ানডে ম্যাচে। তার ১৬৭টি ওয়ানডে, ৩৪টি টেস্ট এবং ৬৮টি টি২০ ম্যাচে ধাওয়ান মোট ১০,৮৬৭ রান করেছেন, যার মধ্যে ২৪টি শতরান এবং ৪৪টি অর্ধশতরান রয়েছে। ধাওয়ানের এই পরিসংখ্যানই প্রমাণ করে তিনি ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন।
কিংবদন্তি ওপেনারের উত্থান ও সাফল্য
ধাওয়ানের ক্রিকেট যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে একটি ওয়ানডে ম্যাচ দিয়ে, যেখানে তিনি মাত্র দুই বলে আউট হন। এরপরের বছর তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে চারটি ওয়ানডে ম্যাচে অংশগ্রহণ করেন এবং সর্বোচ্চ ৫১ রান করেন। তবে তার সত্যিকারের উত্থান ঘটে ২০১৩ সালে বর্ডার-গাভাস্কার ট্রফিতে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে তার টেস্ট অভিষেকে, যেখানে তিনি মাত্র ৮৫ বলে শতরান করে রেকর্ড গড়েন। ধাওয়ান জানান, “আমার টেস্ট অভিষেক আমার ব্যক্তিগত প্রিয় মুহূর্ত। আমি ভারতের হয়ে খেলতে এবং বিশ্ব রেকর্ড করতে স্বপ্ন দেখতাম।” তার এই স্বপ্ন পূরণের মুহূর্তটি শুধু তার জন্য নয়, ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
এর পরেই ২০১৩ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ধাওয়ান তার প্রতিভার প্রকাশ ঘটান। মহেন্দ্র সিং ধোনি নতুন ওপেনিং জুটি হিসেবে শিখর ধাওয়ান এবং রোহিত শর্মাকে নির্বাচন করেছিলেন, যেখানে ধাওয়ান পরপর সেঞ্চুরি করেন এবং মোট ৩৬৩ রান সংগ্রহ করে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হন। ভারত সেই প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতে। ধাওয়ান-রোহিত জুটি ক্রিকেটপ্রেমীদের কাছে অতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
আইসিসি টুর্নামেন্টের নির্ভরযোগ্য প্লেয়ার
ধাওয়ান নিজেকে আইসিসি টুর্নামেন্টের জন্য ভারতের নির্ভরযোগ্য ওপেনার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপে ধাওয়ান ৪১২ রান করে ভারতের সর্বোচ্চ স্কোরার হন, যেখানে তার দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ১৩৭ রানের ইনিংসটি অন্যতম সেরা বলে বিবেচিত হয়। ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে তিনি আরও ৩৩৮ রান করেন। রোহিত শর্মার সঙ্গে ধাওয়ানের জুটি টেন্ডুলকার-গাঙ্গুলির পর ভারতের দ্বিতীয় সর্বাধিক সফল ওপেনিং জুটি হিসেবে পরিগণিত হয়। তাদের জুটি ভারতীয় ক্রিকেটে বহু স্মরণীয় মুহূর্ত উপহার দিয়েছে।
হতাশার মুহূর্ত
২০১৯ বিশ্বকাপে ধাওয়ান সর্বশেষ আইসিসি টুর্নামেন্টে খেলেছিলেন, যেখানে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে আঘাত পাওয়া সত্ত্বেও ১১৭ রান করেন। এটাই ছিল ধাওয়ানের শেষ আন্তর্জাতিক শতরান। এরপর ধাওয়ানকে সীমিত ওভারের ক্রিকেট থেকে সরিয়ে রাখা হয়। টেস্টে তার ক্যারিয়ারও তেমন ভাবে এগোতে পারেনি—৪০টি ম্যাচে তিনি ২,৩১৫ রান করেছেন। ধাওয়ানের টেস্ট ক্যারিয়ার যে প্রত্যাশা নিয়ে শুরু হয়েছিল, তা শেষ পর্যন্ত সেই উচ্চতায় পৌঁছায়নি। তবে টেস্ট ক্রিকেটে তার কিছু অনবদ্য ইনিংস রয়েছে, বিশেষত শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে করা তার তিনটি সেঞ্চুরি।
ধাওয়ান ২০২২ সালে ভারতের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে অধিনায়কের ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা এবং নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরোয়া সিরিজেও খেলেছিলেন। তবে শুবমান গিল এবং ইশান কিশানের মতো নতুন প্রতিভাদের উত্থান ধাওয়ানের জন্য জায়গা সংকুচিত করে দেয়। ধাওয়ান যদিও তার ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছিলেন, কিন্তু নতুন প্রজন্মের ব্যাটসম্যানদের গতিময়তা তাকে পিছনে ফেলে দেয়।
২০২৩ সালের আগস্টে, এশিয়ান গেমসের জন্য ভারতীয় দলে সুযোগ না পাওয়ার পর ধাওয়ান তার হতাশা প্রকাশ করেছিলেন।
তিনি তার বিদায়ের বিষয়ে বলেছেন, “জীবনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পৃষ্ঠাটি উল্টানো গুরুত্বপূর্ণ এবং সেই কারণেই আমি আন্তর্জাতিক এবং ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে আমার অবসর ঘোষণা করছি।” ধাওয়ানের এই মন্তব্য তার শান্ত ও পরিণত মানসিকতার প্রতিফলন করে।
ধাওয়ান তার ১৪ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার থেকে ২৪টি আন্তর্জাতিক শতরান (১৭টি ওয়ানডে এবং ৭টি টেস্ট) এবং মোট ২৬৯টি ম্যাচ খেলে ১০,৮৬৭ রান সংগ্রহ করে বিদায় নেন। ধাওয়ান বলেন, “আমি মন শান্ত রাখছি যে আমি এতদিন ভারতের হয়ে খেলেছি। আমি নিজেকে বলেছি যে ভারতীয় দলের হয়ে না খেলতে পারায় মন খারাপ করো না, বরং এই ভেবে খুশি হও যে তুমি দেশের হয়ে খেলেছ।”
ধাওয়ানের অবসর: অনুরাগীদের প্রতিক্রিয়া এবং ভবিষ্যৎ
ধাওয়ানের বিদায়ের পর, তার ভক্ত এবং সহকর্মীরা তাকে স্মরণ করছেন। অনেকেই তাকে “গব্বর” নামে ডাকতেন, তার সাহসী এবং আগ্রাসী ব্যাটিংয়ের জন্য। ধাওয়ান তার আইপিএল ক্যারিয়ারে দিল্লি ক্যাপিটালস, মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স, ডেকান চার্জার্স, সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদ এবং পাঞ্জাব কিংসের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তিনি ৬,৭৬৯ রান করেছেন ২২১ ইনিংসে, স্ট্রাইক রেট ১২৭.১৪। ধাওয়ান আইপিএলে তার যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য প্রেরণা হিসেবে থাকবেন।
ধাওয়ানের অবসর ভারতীয় ক্রিকেটের একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটালেও, তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। “গব্বর” নামে পরিচিত এই ক্রিকেটার তার সাহসী ব্যাটিংয়ের জন্য সর্বদা স্মরণীয় থাকবেন। ভবিষ্যতে ধাওয়ান, লিগ ক্রিকেটে খেলতে থাকবেন এবং তার অভিজ্ঞতা দিয়ে তরুণ ক্রিকেটারদের সহায়তা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।