ইতিহাস

বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি: প্রাচীন এই ভাষাটির জন্ম ও ইতিবৃত্ত নিচে আলোচনা করা হলো

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা ভাষা ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পেয়েছে। বাংলা ভাষার জন্ম এবং বিবর্তন একটি দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া, যা হাজার হাজার বছর ধরে চলেছে। প্রাকৃত, অপভ্রংশ থেকে শুরু করে, মুগল এবং ব্রিটিশ শাসনের সময়ে ভাষাটির উপর বিভিন্ন সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছে। তবে বাংলা ভাষা তার নিজস্ব সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে এবং আজ এটি বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ ভাষা হিসেবে স্বীকৃত।

বাংলা ভাষার জন্ম এবং ইতিবৃত্ত:

বাংলা ভাষার জন্ম এবং বিবর্তন একটি দীর্ঘ এবং সমৃদ্ধ ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত। এটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারভুক্ত এবং প্রধানত পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশে ব্যবহৃত। বাংলা ভাষার বিবর্তনের প্রক্রিয়া হাজার হাজার বছরের দীর্ঘ এবং এটি আর্য এবং দ্রাবিড় ভাষার মিশ্রণের ফলে উদ্ভূত হয়েছে।

প্রাকৃত এবং অপভ্রংশের ভূমিকা:

বাংলা ভাষার মূল উৎপত্তি প্রাচীন সংস্কৃত থেকে হলেও এর সরাসরি পূর্বসূরি ভাষা হল “মাগধী প্রাকৃত” এবং “অপভ্রংশ”। খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দ থেকে মাগধী প্রাকৃতের ব্যবহার শুরু হয়, যা পরে পাল, সেন, এবং মুসলিম শাসনকালে বিকশিত হয়ে অপভ্রংশ রূপ ধারণ করে। ১০০০ থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অপভ্রংশ ভাষা বিকশিত হয়ে বাংলায় রূপান্তরিত হয়।

বাংলা ভাষার বিকাশ এবং বিভক্তি:

বাংলা ভাষার আদি বিকাশ ঘটে প্রধানত গৌড়, বঙ্গ, এবং বরেন্দ্র অঞ্চলে। ১৪শ শতকের কাছাকাছি সময়ে বাংলা ভাষার সাহিত্যিক রূপ পায় এবং এই সময়েই মহাকাব্য এবং বিভিন্ন ধরনের সাহিত্য রচনা শুরু হয়। বিশেষ করে, “চণ্ডীদাসের” মতো কবিরা বাংলা ভাষার প্রাচীন সাহিত্যিক চরিত্রকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই সময়কালে বাংলা ভাষার বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক রূপ বিকশিত হয়, যেমন রাঢ়ী, পশ্চিমবঙ্গের ভাষা, এবং বাংলাদেশে প্রচলিত পূর্ব বাংলা।

মুগল ও ব্রিটিশ শাসনের সময়:

মুগল আমলে বাংলা ভাষা আরবি এবং ফার্সি ভাষার প্রভাব গ্রহণ করে। এ সময় ফার্সি ভাষা প্রশাসনিক কাজে ব্যবহৃত হলেও বাংলা ভাষার ব্যবহার সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ছিল। ব্রিটিশ শাসনের সময়ে, বিশেষ করে ১৮শ শতকের পর থেকে, বাংলা ভাষার সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশে একটি বড় পরিবর্তন আসে। ১৮০১ সালে উইলিয়াম কেরির উদ্যোগে “ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে” বাংলা ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয় এবং এর মাধ্যমে বাংলা ভাষার প্রথম গদ্য সাহিত্যের সূচনা হয়।

আধুনিক বাংলা ভাষার উদ্ভব:

ঊনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণে বাংলা ভাষার সাহিত্যিক রূপ নতুন করে বিকশিত হয়। এই সময়ের বিখ্যাত কবি এবং সাহিত্যিকদের মধ্যে “মাইকেল মধুসূদন দত্ত”, “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর”, এবং “বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়” ছিলেন অগ্রগণ্য। তাঁদের রচনায় বাংলা ভাষার সাহিত্যিক রূপ পরিপূর্ণতা লাভ করে এবং বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে উল্লেখযোগ্য স্থান অর্জন করে।

বাংলা গদ্যরীতির বিকাশ:

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে আধুনিক বাংলা গদ্যের জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উনিশ শতকে, যখন বাংলা ভাষার ব্যবহারিক গদ্যরীতি ছিল অত্যন্ত জটিল এবং দুর্বোধ্য, তখন বিদ্যাসাগর সহজ, সরল এবং প্রাঞ্জল গদ্যরীতি প্রবর্তন করেন। তাঁর রচিত “বর্ণপরিচয়” বইটি শিশুদের জন্য বাংলা ভাষার প্রথম সহজ এবং সরল পাঠ্যপুস্তক হিসেবে বিবেচিত হয়। এই বইটি বাংলার ভাষা শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও সহজ এবং সাধারণ মানুষের জন্য উপলব্ধ করে তোলে।

Barnaparichoy
– বর্ণপরিচয়

বাংলা ভাষার শিক্ষাব্যবস্থায় সংস্কার:

বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষা শিক্ষার প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর উদ্যোগে সংস্কৃত কলেজে বাংলা ভাষা শিক্ষার প্রচলন হয় এবং তিনি বাংলা ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। এরই অংশ হিসেবে তিনি প্রাথমিক শিক্ষার জন্য সহজপাঠ্য বই রচনা করেন এবং বাংলা ভাষার শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।

ধ্রুপদী ভাষা কী?

‘ধ্রুপদী ভাষা’ (Classical Language) একটি বিশেষ ভাষাগত মর্যাদা, যা ঐতিহ্যবাহী এবং প্রাচীন ভাষাগুলিকে প্রদান করা হয়। এই স্বীকৃতিটি ভাষার ঐতিহাসিকতা, সাহিত্যিক সমৃদ্ধি এবং অন্তত ১৫০০ থেকে ২০০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যকে স্বীকার করে। ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে সেই ভাষার নিজস্ব প্রাচীন সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থাকা আবশ্যক। এই ধরণের স্বীকৃতি পাওয়ার মাধ্যমে ভাষাটির সংরক্ষণ এবং গবেষণার জন্য বিশেষ আর্থিক এবং প্রশাসনিক সুবিধা প্রদান করা হয়।

বাংলা ভাষা কিভাবে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি পেল?

বাংলা ভাষার ধ্রুপদী স্বীকৃতি পাওয়ার পেছনে একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বাংলা ভাষার প্রাচীন ইতিহাস প্রায় ২,৫০০ বছরের পুরনো, যা সাহিত্য, সংগীত এবং সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ভাষার এই ঐতিহ্যকে স্বীকৃতি দিতে দীর্ঘদিন ধরে প্রচেষ্টা চালিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে বাংলা ভাষার এই ইতিহাস এবং সংস্কৃতিগত অবদান তুলে ধরেন। গবেষণার ভিত্তিতে একটি তিনটি ভলিউমের প্রতিবেদন কেন্দ্রীয় সরকারকে জমা দেওয়া হয়, যেখানে বাংলা ভাষার ইতিহাস, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক অবদান উল্লেখ করা হয়। অবশেষে ২০২৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকার বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা প্রদান করে।

ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পেলে কী সুবিধা পাওয়া যায়?

ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা পেলে ভাষাটি বিভিন্ন সুবিধা পায়, যা তার প্রচার, সংরক্ষণ এবং গবেষণার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে। এই ধরনের সুবিধাগুলি ভাষার দীর্ঘমেয়াদী টেকসই উন্নয়নে সাহায্য করে। এর মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য সুবিধা হলো:

  • গবেষণা এবং উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ: ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতির পরে, ভাষার উপর গবেষণা এবং সংরক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার থেকে আর্থিক সাহায্য বরাদ্দ করা হয়।
  • ভাষার সংরক্ষণ: ধ্রুপদী ভাষার সংরক্ষণের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভাষার পড়াশোনা এবং গবেষণার ব্যবস্থা করা হয়।
  • সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক উদযাপন: ধ্রুপদী ভাষাগুলি নিয়ে বিভিন্ন সাহিত্য উৎসব, সেমিনার এবং গবেষণা প্রকল্প আয়োজিত হয়, যা ভাষার সাংস্কৃতিক প্রভাবকে আরো বিস্তৃত করে।
  • আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি: ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভাষাটির গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায় এবং ভাষা গবেষণার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও উদ্যোগের সুযোগ সৃষ্টি হয়।

কেন কলকাতায় বাংলায় সাইনবোর্ডের প্রয়োজন?

কলকাতা, বাংলার রাজধানী এবং সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু হওয়া সত্ত্বেও, শহরের বিভিন্ন এলাকায় দোকান এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডে বাংলার পরিবর্তে অন্যান্য ভাষার প্রাধান্য দেখা যায়। হিন্দি, ইংরেজি, এমনকি উর্দুর আধিক্য রয়েছে। এই পরিস্থিতি শহরের বাংলা ভাষাভাষী জনগণের জন্য ভাষার গুরুত্ব এবং শহরের সংস্কৃতিগত পরিচয় ক্ষুণ্ণ করে। ধ্রুপদী ভাষার মর্যাদা প্রাপ্তির পরে, কলকাতা পুরসভা উদ্যোগ নিয়েছে যে, বাংলাকে আরও বেশি প্রাধান্য দেওয়া হবে, বিশেষত দোকান এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে।

কলকাতা পুরসভা শহরের দোকান ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্যে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। শহরের সমস্ত দোকানে এবং বাণিজ্যিক কেন্দ্রে দেওয়া হচ্ছে। এটি শহরের বাসিন্দাদের মাতৃভাষার প্রতি গর্ব এবং দায়িত্বের অনুভূতি বাড়াতে সাহায্য করবে।

কলকাতা পুরসভা প্রথমে বড় করে বাংলায় সাইনবোর্ড লেখার জন্য জোর দিচ্ছে তারপর সেখানে অন্যান্য যেকোন ভাষায় সাইনবোর্ড লেখা যেতে পারে। কিন্তু বাংলাকে সবার আগে গুরুত্ব দিতে হবে। পুরসভার এই উদ্যোগটি শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা এবং দায়িত্ববোধ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে।

অতীতেও বাংলা ভাষার প্রচারের উদ্যোগ:

এটি প্রথমবার নয় যে কলকাতায় বাংলা ভাষায় সাইনবোর্ডের ব্যবহার নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে বামফ্রন্ট সরকারের সময়েও এই ধরনের প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং ভাষাবিদ পবিত্র সরকারের নেতৃত্বে বাংলা ভাষার প্রচারের জন্য একটি বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখন শহরের অনেক এলাকায় বাংলায় সাইনবোর্ড এবং বিজ্ঞাপনের প্রচলন শুরু হয়েছিল। তবে সেই সময়ে উদ্যোগটি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি এবং ধীরে ধীরে তা স্তিমিত হয়ে যায়।

বর্তমানে, বাংলা ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি পাওয়ার পর, কলকাতা পুরসভা এই প্রচেষ্টাকে পুনরুজ্জীবিত করতে চাইছে। শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে যেখানে বাংলা ভাষার ব্যবহার কম, সেখানে বাংলা ভাষার গুরুত্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে এই উদ্যোগকে সফল করতে চাইছে পুরসভা।

বাংলা ভাষার ধ্রুপদী স্বীকৃতি পাওয়া কেবল একটি ভাষার ইতিহাসকে সম্মান জানায় না, এটি বাংলা ভাষার সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক অবদানের একটি বড় স্বীকৃতি। এত বছর ধরে বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা করা বহু গবেষকের ফল এই ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি। সমস্ত বাঙালির কাছে এ এক দারুণ গর্বের দিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *