বর্ষীয়ান বাম নেতা Sitaram Yechury প্রয়াত: কমিউনিস্ট নেতার জীবন ও রাজনৈতিক অবদান
Sitaram Yechury: সিপিআই(এম)-এর সাধারণ সম্পাদক ও বর্ষীয়ান নেতা সীতারাম ইয়েচুরি (৭২) , ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪-এ, দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস (AIIMS) এ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসের সংক্রমণের চিকিৎসা চলছিল, তবে শেষ পর্যন্ত তাঁকে আর বাঁচানো যায়নি। ইয়েচুরির মৃত্যুতে দেশের রাজনৈতিক মহলে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
হাসপাতালের ভর্তি ও চিকিৎসা
সীতারাম ইয়েচুরিকে গত ১৯ আগস্ট দিল্লির AIIMS-এ ভর্তি করা হয়েছিল। তিনি শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা এবং নিউমোনিয়া-সদৃশ ফুসফুসের সংক্রমণে ভুগছিলেন। হাসপাতালের একাধিক বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা তাঁর চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন। তাঁকে দ্রুত আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়, এবং তাকে শ্বাসযন্ত্রের সাহায্যে জীবিত রাখা হচ্ছিল। দীর্ঘদিন ধরেই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটছিল, যদিও চিকিৎসকরা প্রথমদিকে তার অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল ছিল বলে জানিয়েছিলেন। তবে সিপিআই(এম)-এর সাম্প্রতিক বিবৃতিতে তাঁর অবস্থার গুরুতরতা তুলে ধরা হয়েছিল।
জীবনের শেষ ভিডিও বার্তা
অগাস্টের শেষের দিকে, হাসপাতালে থাকাকালীন সীতারাম ইয়েচুরি প্রয়াত পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের স্মরণে একটি ভিডিও বার্তা রেকর্ড করেছিলেন। ভিডিওতে তিনি তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী এবং বন্ধু বুদ্ধদেবের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তাঁর শেষ জনসমক্ষে বক্তব্য রাখা এই ভিডিওতেই ছিল, যেখানে তিনি বলেন, “এটা আমার জন্য বিরাট ক্ষতি যে আমি শারীরিকভাবে উপস্থিত থেকে কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে পারলাম না।”
শৈশব ও শিক্ষাজীবন
সীতারাম ইয়েচুরি ১৯৫২ সালের ১২ আগস্ট মাদ্রাজে (বর্তমান চেন্নাই) একটি তেলেগু-ভাষী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা সার্বেশ্বরা সোমায়াজুলা ইয়েচুরি ছিলেন অন্ধ্র প্রদেশ স্টেট রোড ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনের একজন প্রকৌশলী এবং মা কালপাকাম ইয়েচুরি ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা। ইয়েচুরি হায়দ্রাবাদে বড় হন এবং অল সেন্টস হাই স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ১৯৬৯ সালের তেলেঙ্গানা আন্দোলন তাঁকে দিল্লিতে নিয়ে আসে, যেখানে তিনি প্রেসিডেন্টস এস্টেট স্কুলে পড়াশোনা করেন এবং সিবিএসই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সর্বভারতীয় প্রথম স্থান অধিকার করেন। পরবর্তীতে তিনি দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক এবং জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। জরুরি অবস্থার সময় গ্রেপ্তারের কারণে তাঁর পিএইচ.ডি সম্পূর্ণ হয়নি।
রাজনৈতিক জীবন ও সংগ্রাম
সীতারাম ইয়েচুরির রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল ১৯৭৫ সালে, যখন তিনি জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হন। সেখানেই তাঁর রাজনৈতিক বীজ বপন হয় এবং তার পর থেকে তিনি আজীবন ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। ইয়েচুরি সিপিআই(এম)-এর ছাত্র সংগঠন, স্টুডেন্টস ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া (SFI)-র সদস্য ছিলেন এবং ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এই সময় থেকেই তিনি জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা নিতে শুরু করেন।
১৯৯২ সালে তিনি সিপিআই(এম)-এর পলিটব্যুরো সদস্য হন এবং দীর্ঘ সময় ধরে দলীয় নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ২০০৫ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত তিনি রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন এবং বামপন্থী রাজনীতিতে তাঁর প্রভাব ছিল অত্যন্ত গভীর। ২০১৫ সালে সিপিআই(এম)-এর সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হওয়ার পর, তিনি ২০১৮ সালে পুনরায় একই পদে নির্বাচিত হন।
পারিবারিক জীবন
সীতারাম ইয়েচুরির স্ত্রী সীমা চিশ্তি, এক পুত্র এবং এক কন্যাকে রেখে গেছেন। তবে, ২০২১ সালে কোভিড-১৯-এর কারণে তাঁর বড় ছেলে আশীষ ইয়েচুরি মারা যান। এই ঘটনা ইয়েচুরির জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। জনসমক্ষে শোক প্রকাশ না করলেও, এই ব্যক্তিগত ক্ষতি তাকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করেছিল।
রাজনৈতিক নেতৃত্বে অবদান
সীতারাম ইয়েচুরি শুধু সিপিআই(এম)-এর সাধারণ সম্পাদকই ছিলেন না, বরং ভারতীয় বামপন্থী রাজনীতির এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বও ছিলেন। বামপন্থী আন্দোলনের নীতি প্রণয়নে তার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল, বিশেষ করে ১৯৯৬ সালের ইউনাইটেড ফ্রন্ট সরকারের যৌথ ন্যূনতম কর্মসূচী (Common Minimum Programme) প্রণয়নে তার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি কেবল ভারতীয় রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কে সাক্ষী ছিলেন না, বরং সেই সময়ের একজন নির্দিষ্ট প্রবক্তা ছিলেন।
রাজনৈতিক মহলে প্রতিক্রিয়া
সীতারাম ইয়েচুরির মৃত্যুতে দেশজুড়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা শোক প্রকাশ করেছেন। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী তাকে ‘একজন বন্ধু’ এবং ‘ভারতের ধারণার রক্ষক’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, “সীতারাম ইয়েচুরি জি ছিলেন একজন বন্ধুবৎসল মানুষ। ভারতের রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে তাঁর গভীর উপলব্ধি ছিল। আমি আমাদের দীর্ঘ আলোচনা ও বিতর্কগুলি খুব মিস করবো। তাঁর পরিবার, বন্ধু ও অনুগামীদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই।”
এদিকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নীতিন গড়করি গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, “সীতারাম ইয়েচুরির অবদান সর্বদা স্মরণীয় থাকবে। তার পরিবার এবং প্রিয়জনদের প্রতি আমার আন্তরিক সমবেদনা। ওম শান্তি।”
শেষকৃত্য ও শ্রদ্ধা নিবেদন
সিপিআই(এম) সূত্রে জানা গেছে, সীতারাম ইয়েচুরির শেষকৃত্য তার পারিবারিক এবং দলীয় সদস্যদের উপস্থিতিতে সম্পন্ন হবে। পার্টির পক্ষ থেকে তাঁকে একাধিক কর্মসূচির মাধ্যমে স্মরণ করা হবে, যেখানে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের বামপন্থী নেতা এবং সমর্থকরা তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাবেন।
সীতারাম ইয়েচুরির মৃত্যুতে ভারতের বামপন্থী আন্দোলনের একটি অধ্যায় শেষ হল। তাঁর নেতৃত্ব, সংগ্রাম ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আগামীর নেতা ও কর্মীদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।